Forum

বাংলা বই ও তার পাঠক

কোন একটি বিষয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা একমত হয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল । তবু ক্ষমাঘেন্না করে যে গুটিকয় বিষয়ে তাঁরা নেহাতই একমত হয়ে ধন্য করেন, তার একটা হল -... বাংলা বইয়ের পাঠক সংখ্যা কমছে হু হু করে । তাঁদের গিলে খাচ্ছে ছোটো, বড় পর্দা । আর মোবাইল তো বাক্যজীবি বঙ্গজদের জপমালা হয়ে উঠেছে। বই পড়বেন কখন ? সুতরাং গ্রন্থাগারে পাঠক - পাঠিকার সংখ্যা কমছে; শারদ সংখ্যাগুলোর দাম কমছে; উপহারে বই দিলে প্রাগৈতিহাসিক জীব হিসাবে তকমা পাবার আশঙ্কা থাকছে।

সে সব কাটাতে বইওয়ালারা অবশ্য বসে নেই। নিত্য নতুন আইডিয়া এসেছে, আসছে। দু, একটা দেখুন। একজন লেখক গল্প শুরু করছেন, বিস্তার করছেন অন্যজন এবং শেষ করছেন তৃতীয় ব্যক্তি।  পত্রিকার মতো কবিতার বইতেও রেখাচিত্র থাকছে। দুর্বোধ্য হলে পোয়াবারো। থাক্ গে।  অচিরেই বই হিসেবে ছাপা উপন্যাসের পাতায় থাকবে রং করা ছবি।  তাতে একঢিলে দুই পাখি মারা পড়বে -. লেখা এবং আকাঁ। তৃতীয় নমুনা হল, বালতি কিনলে চামচ ফ্রি -র মতো বহুকাল আগে থেকেই বই কিনলে গানের ক্যাসেট বা ক্যালেণ্ডার বিনামূল্যে দিয়ে পাঠক টানার চেষ্টা হচ্ছে।
 বাংলা বই বিক্রির ক্রিয়েটিভ টীম এতেই হাল ছাড়বে বলে মনে হয় না। আগামীতে যে সব অভূতপূর্ব চমক ধেয়ে আসবে বলে মনে হয়, তার দু একটি কল্পনা করি আসুন।  এক, সম্ভবতঃ এক বা একাধিক লেখকের বদলে পাঠক নিজেই শেষ করবেন উপন্যাসের অন্তিমপর্বটু্কু।  তার জন্য গ্রন্থশেষে বেশ কিছুটা সাদা পাতা দেওয়া থাকবে। এতে যেমন গণতন্ত্র থাকবে, তেমন পাঠকই লেখক হওয়ার গরিমা অর্জন করবেন। দুই, কাহিনী শেষ হলে থাকবে ক্যুইজ। সঠিক উত্তর দিতে পারলে দীঘা বা ইয়ান থাং মতো কোন জায়গায় দু - রাত, তিন অপরাহ্ন ফ্রি।  তিন, বিয়ের কার্ডে এখন সুগন্ধ মাখানো হচ্ছে।  খাম খুললেই ভরে ওঠে মন।  এবার বইয়ের পাতায় পাতায় থাকবে আলাদা, আলাদা সুগন্ধ।  রাগের অধ্যায়ে ঝাঁঝালো, প্রেমে সুবাসিত, শোকে হৃদয় বিদারক গন্ধে উচাটন হবেন পাঠক।  চার, উপন্যাসের নায়ক, নায়িকারা নির্দিষ্ট কোন এক ব্রান্ডের পানীয় পান করবেন;... ছুটি কাটাবেন নির্দিষ্ট কোন কোম্পানির লজে।  সে সবের বিবরণ থাকবে রসিয়ে।  ফলে পাঠক বা পাঠিকা বুঝতেই পারবেন না, কিভাবে স্পন্সরড্ ব্রাণ্ডের দাপটে উপন্যাসের চরিত্রগুলো তাঁদের পছন্দ, অপছন্দ নির্ধারন করে দিচ্ছে।  ক্রমে স্পন্সরাই বলে দেবে উপন্যাস কখন ও কিভাবে লেখা হবে।  পাঁচ, বই এর পাতায় আকাঁ ছবিতে মডেল হতেই পারেন টলি -.... বলির পড়তি ও উঠতি নায়ক, নায়িকারা।  পুনর্বাসনও হল, গ্ল্যামারও থাকল।  তবে, ষষ্ঠতম বিষয়্টা হতে পারে চরমতম।  প্রতিটি অধ্যায় লিখে এস এমএস -.... এ ভোট চাওয়া হবে উপন্যাস বা নাটকের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি নিয়ে।  সর্বাধিক প্রাপ্ত এস এম এস ঠিক করে দেবে উপন্যাসের চলন।  এতে জনপ্রিয়তা নিয়ে লেখককে আর ভাবতে হবে না কারণ জনপ্রিয়তার কবচকুণ্ডল নিয়েই তখন লেখার জন্ম হবে।  আর প্রজেক্ট ভেবে যদি সঙ্গীতের জন্ম হয়, তবে লেখা কেন নয়? হয়তো একটা বৃহৎ রচনার এক একটি অধ্যায় লিখবেন এই পৃথিবীর ভিন্ন, ভিন্ন স্থানে থাকা মানুষ। সে সব থেকে চার্লস ল্যামের মতো কোন এক দক্ষ সম্পাদকের কাটা জোড়ায় জন্ম হবে আরেকটা কালোত্তীর্ণ টেস্ট টিউব সাহিত্য।

এবার আসুন কল্পনার ডানা মুড়ে বাস্তবে ফিরে আসি।  একথা ঠিক যে ঢাউস, ঢাউস বাংলা উপন্যাসের দিন গিয়েছে চলে। বালিশ হিসেবে কাজে লাগার সম্ভাবনা -... 'নিল'।  কারণ অধিকাংশের এখন সার্ভিকাল স্পণ্ডিলাইটিসের ব্যামো কাজেই বই হয়ে উঠছে স্লিম, পুনরুক্তি, অতিবর্ণন বর্জিত এবং অনবদ্য প্রচ্ছদ শোভিত।  ভাবলে অবাক হতে হয়, ক ' বছর আগেও এ বঙ্গে যে খানে বাংলা ভাষায় বই ছিল হাতে গোনা, আজ সেখানে শত, শত। হাতির জীবন থেকে উদ্ভিদ বিদ্যার অভিধান বাংলায় প্রকাশনার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন প্রকাশকরা।  বড়র সঙ্গে অর্বাচীনেরাও বই এর জ্যাকেট করছেন চোখে পড়ার মতো।  সে সব মোটেই দায়সারা ক্যাটকেটে নয়।  বরং রেইজ, এমবোস, ডিজিটাল মিলে কোন, কোন বাংলা বই এর প্রচ্ছদ যেন নিজেই এক মূর্ত্ত আর্ট।  দাম কমাতে এক পাতায় পিঁপড়ের সারি না দিয়ে, মোটা পাতায় বড় ফণ্টে যথেষ্ট ফাঁকা দিয়ে আধুনিক হচ্ছে বাংলা প্রকাশনা।  নিত্য, নতুন বই এর হদিশ নিয়ে কোনও এক নিসঙ্গ বিজ্ঞাপন নয়, বরং শুধু বই এর হদিশ দিতে বেরোচ্ছে বাংলা পত্রিকা । এত সবে দাম হয়তো বাড়বে.. কিন্তু তাতে পিছপা নয় কেউই।


বই যে এত বই বেরুচ্ছে, কিনছে কারা? নিশ্চয়ই বাংলা পড়তে পারেন এমন পাঠক, পাঠিকাগণ। তাহলে বাংলা বই পড়ার অভ্যাস কমছে -. একথা শর্তহীনভাবে বলা যায় কি? তবে তলিয়ে দেখলে চোখে পড়বে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য ছাড়া নরনারীর চিরকেলে প্যানপেনে প্রেমাভিলাষের গদগদ বর্ণনের জায়গা নিচ্ছে সিরিয়াস লেখা।  ইঙ্গিত পরিস্কার উপলব্ধি, ভাবনা মৌলিক হওয়া চাই ।লেখা হতে হবে তথ্য নির্ভর পুরাতন, নতুন -..... সব কিছুর চাই চিত্তাকর্ষক বিশ্লেষণ।  শুধু আবেগ, দূর হটো। 


 বদলে যাচ্ছে সময় - বদল হচ্ছে পাঠক চিত্তের নতুন ধরনের বাংলা বই এর জন্য প্রস্তুত পাঠক।  প্রশ্ন হল, লেখক প্রস্তুত তো..?


লেখক - অগ্নি মিত্র।     .• মতামত - লেখকের ব্যক্তিগত।

Contact Us

1 comment:

  1. মজার লেখা হলেও ভাবায়।

    ReplyDelete